
ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের শেষ মাথায় লাল ইটের ভবন। পাশেই ছায়ানট। হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্বুলের ভবনটা তিন তলা। নিচ তলায় অফিস রুম। লাইব্রেরী। ছোট্ট খেলার মাঠ। একটা বাস্কেট বল কোর্ট। এটারই এক পাশে টেনিস লন। নিচতলার ডানদিকের বিশাল রুমে কম্পিউটার ল্যাব। টিচার্স কমন রুম। শান্তনুদের ব্যাচে শিক্ষার্থী ৫২ জন। তিন তলায় সাজানো ক্লাস রুম। শান্তনুর বাসা থেকে স্কুল পনের মিনিটের পথ। বেশিরভাগ সময় সামদানি সাহেব গাড়ি দিয়ে ড্রপ দেন। শান্তনু একা ফেরে। মইনাক আর রাশেদ ছাড়াও শান্তনুর আরেকজন খুব ঘনিষ্ট বন্ধু নেহা।
নেহাদের বাসা লেকপাড়েই। ১৬/এ নম্বর রোডের শেষ মাথার সবুজ ঘেরা বাড়িটা। নেহার বাবা নাজমুল ইমাম। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। গামেণ্টস এর ব্যবসা। খুব নাম ডাক। ফেরার সময়ে বেশিরভাগ সময়েই নেহার গাড়িতে ১৬/এ পর্যন্ত গিয়ে নেমে রিকশা ধরে শান্তনু। নেহার পুরো নাম নুরুননাহার। নুরুন্নাহার নেহা। দাদি খুব আদর করে নাম রেখেছিলেন নুরুন্নাহার। নুর মানে আলো। আলোয় আলোয় আলোকিত। আলোর মতোই চেহারা। বাম গালের ঠিক মাঝখানে একটা তিল। ঝকমকে দাত। স্কুল ড্রেসে দুই বেনীতে অদ্ভুত একটা মায়া মাখানো চেহারা। টানা চোখ। ধবল শাদা গায়ের রঙ। মিস্টি হাসিতে টোল পড়ে। ও লেভেলেই ভর্তি হয়েছে নেহা। এর আগে কোন একটা স্বুলে পড়তো। এইতো মাস ছয়েক আগে কোর্স শুরু হলো।
সেদিন ছিল শনিবার। সকাল ৯টা থেকে স্কুল। সামদানি সাহেব নামিয়ে দিলেন শান্তনুকে। বৃষ্টি হচ্ছিল গুড়ি গুড়ি। এক দৌড়ে বারান্দায় শান্তনু। পুরু চশমায় ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল। ছোট খাটো সৌম্য চেহারা। কাধেঁ স্কুল ব্যাগ। বৃষ্টির পানিতে ঘোলা হয়ে গিয়েছিল পুরু চশমা। আবছা দেখছিল। ঠিক সামনেই দাড়ানো নেহা। অফিস রুমের সামনে। সাদা কালো চেক এর স্কুল ড্রেস। শাদা কেডস। স্পষ্ট মনে আছে শান্তনুর। পকেট থেকে রুমাল বের করে গ্যাস মুছে তাকিয়েছিল। ক্লাসের সব বন্ধুদের সাথেই ভালো সম্পর্ক শান্তনুর। শান্তশিষ্ট আর মৃদুভাষী বলে সবার প্রিয়ও। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স প্রীতির কারনে অনেকে মজা করে নামও বদলে ফেলেছে শান্তনুর। শান্তনুর বাবা রেডিওতে চাকুরি করেন। শান্তনুও ক্লাস পার্টিতে একবার একটা ট্রানজিষ্টর প্রেজেন্ট করেছিল। সেই থেকে বন্ধুরা মি. ট্রানজিসন্টর বলেও ডাকে আড়ালে আবডালে। মুখ টিপে হাসে। শান্তনু বোঝে সব। কিন্তু এমন করে কাউকে তো ভালো লাগেনি কখনো।
গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে খানিকটা ভিজে গিয়েছিল শান্তনু। নেহারও চুল ভেজা ভেজা। পোশাকে জলের ছাপ। আকাশ বেশ কালো হয়ে আড়াল করেছে আলোকে। দিনের বেলাতেও বারান্দায় বাতি জ্বলছে। এখানে সেখানে ছেলে মেয়েদের জটলা। পনের বসন্তের একটা কিশোরের মনে কী যেন খেলে যায় নেহাকে দেখে। মনে হয় যুগ জনমের চেনা কেউ। কাউকে কাউকে প্রথম দেখাতেই এত আপন মনে হয়, নেহাকে না দেখলে তা হয়তো এ জীবনে অনুভব করতে পারতো না শান্তনু। পুরু চশমার ভেতর দিয়ে হা করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষন। নেহাও হয়তো বুঝতে পারে বিষয়টি। মিস্টি একটা হাসিতে এই তাকানোর জবাবটা দিয়ে ফেলে নিজের অজান্তে। ওই হাসিতে যেন আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। মেঘ কেটে উকিঁ দেয় জ্বলজ্বলে সূর্য।
বারান্দা ছেড়ে তিন তলার ক্লাসরুমে ছুটে যায় শান্তনু। চিরচেনা হইচই। একান্ন জন পুরনো বন্ধুর সান্নিধ্য কিছু সময়ের মধেই ভুলিয়ে রাখে মনের আকাশে উকিঁ দেয়া একটা নতুন সূর্যের কথা। প্রথম ক্লাস জামান স্যারের। ঘন্টা বাজে। জামান স্যারের সাথে ক্লাসরুমে ঢোকে নতুন অতিথি নেহা। শান্তনুর বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। যেন এই মুহুর্তটারই প্রার্থনা করছিল এতক্ষণ। সে বন্ধু হোক আর যাই হোক। এ যেন হাজার বছরের চেনা কেউ। এত ভালো কেন লাগছে। বুকের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারেনা শান্তনু। হয়তো কিছু অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা থাকেনা। মানব মনের জটিল রসায়নে বিক্রিয়ায় আবর্তিত হয় নিজের অজান্তেই। এক্ষেত্রে কারো কোন হাত থাকেনা। কারও কিছু করার থাকেনা।
জামান স্যারের সাথে ডায়াসে উঠে গুটিসুটি মেরে দাঁড়ায় নেহা। প্রথম দিনটি এখনো চোখে জ্বলজ্বল করে ভাসে শান্তনুর। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল নেহার। লজ্জা যেন লুকোতে পারছিলনা কিছুতে। পরিচয় করিয়ে দেন জামান স্যার।
‘ প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আজ আমি একজন নতুন বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেবো। ওর নাম নুরুন্নাহার। ডাক নাম নেহা। আজ থেকে আমাদের নতুন সহযাত্রী’’
মুচকি হেসে হাত নাড়ে নেহা।‘ হাই ফ্রে-জ, আই এম ইওর নিউ ফ্রেন্ড। হোপ ইউ অল আর বি উইথ মি’। স্পষ্ট পশ্চিমা ইংরেজি উচ্চারনে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নেহা। সবাই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায় নেহাকে। তারপর পুরো ক্লাসে আনমনে নেহার কথাই ভাবছিল শান্তনু। কেন জানে না। নেহা যে ইংরেজি উচ্চারনে এত ভালো তার সাথে না বুঝলে তার আসল রুপ অজানাই থেকে যেতো।
আধুনিক অভিজাত পরিবারের সন্তান নেহা। স্টাইলিশ। কিন্তু ঐতিহ্য ছাড়েনি। পছন্দ তার রবীন্দ্রনাথ। খুব ভালো বাংলা উচ্চারণে আবৃতি করতে পারে। উৎসবে বাঙালি ঢঙে শাড়ি পরে হাতে কনুই পর্যন্ত চুড়ি পরে মেহেদি রাঙাতে পারে। খুব কাছে থেকে না মিশলে এসব অজানাই থেকে যেতো শান্তনুর।
প্রথম দিন টিফিন পিরিয়ডেই নেহার মুখোমুখি দাড়ায় শান্তনু।
’ নেহা, আমি শান্তনু। পুরো নাম শফিকুল সামদানি শান্তনু।‘ হাত বাড়িয়ে দেয় নেহা।
‘ আমরা থাকি লেক পাড়ে। লেকভিউ এপার্টমেন্টে।‘
‘ ওহ তাই নাকি। আমরা থাকি ১৬/এ।আমার বাবার নাম নাজমুল ইমাম। সড়কের শেষ বাড়িটা আমাদের।‘ হাস্যোজ্বল নেহা।
‘ নাইস টু মিট ইউ ফ্রে-’ বলে হাত বাড়িয়ে দিতেই হই হই করে তেড়ে আসে রাশেদ ও মইনাক। ’’ এই মিস্টার ট্রানজিষ্টর। করো কি। করো কি। হাই। দিস ইজ রাশেদ। হ্যালো দিস ইজ মইনাক। নাইস টু মিট ইউ অলসো। কি বলো মিস্টার ট্রানজিষ্টর। হাহাহাহাহা।‘’
মিস্টার ট্রানজিষ্টর এর মানে বোঝেনা নেহা। অকারনেই হাসিতে তাল মেলায়। একসংগে বেরিয়ে পড়ে ক্লাস শেষে।
পাজেরো গাড়িতে কালো গ্লাসের আড়ালে ঢেকে চলে যায় নেহা। হাত নাড়ে শান্তনু। রিকশা খুঁজতে থাকে। সূর্য তখন পশ্চিমে গড়াতে শুরু করেছে। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। মইনাক আর রাশেদ মিলে রিকশা ঠিক করে। আকাশ জোড়া মেঘ। থেমে থেমে ছিটেফোটা বৃষ্টি।শীত শীত ভাব। আজ পুরো ধানমন্ডিটা একটা চক্কর দেবে তিন বন্ধু। সন্ধ্যার আগে রবীন্দ্র সরোবরে ফুচকা খেয়ে তারপর বাসায় ফিরবে।
ধানমন্ডির সাতাশ নাম্বার থেকে রিকশার চাকা গড়াতে থাকে। মইনাক রিকশার হুডের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে। শান্তনু আর রাশেদ সিটে। চিরচেনা যানজট। টুংটাং বেল বাজিয়ে চলে রিকশা। শান্তনুর মন পড়ে থাকে সেই বৃষ্টি ভেজা বারান্দায়। যে মুহুর্তটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে তার কচি মনের গোপন দরজা। সেই দরজায় কে দাঁড়াবে কে জানে ? হই চই এ মেতে ওঠে মইনাক আর রাশেদ। শান্তনু তলিয়ে যেতে থাকে ভালোলাগার অতল এক অদ্ভুত রাজ্যে। যেখানে গাছে গাছে, ফুলে ফুলে শুধু নেহার মুখচ্ছবি। আর কিছু নেই সেখানে।
No comments:
Post a Comment