Saturday, May 11, 2019

ধারাবাহিক কিশোর সায়েন্স ফ্যান্টাসি- স্কুল ট্রিপে নাসা অভিযান

স্কুল ট্রিপে নাসা অভিযান , কিশোর সায়েন্স ফ্যান্টাসিটি ২০১৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ধারাবাহিকভাবে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে আগ্রহী পাঠকদের জন্য প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

আজ এর প্রথম পর্ব।

 

(এক)
বিকাল সাড়ে ৩টা। মেঘের কুণ্ডলি থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামছে সুপরিসর বিমান বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিলাসবহুল বিমানটির সাড়ে ৪শ যাত্রীর মধ্যে বেশিরভাগ এখনো ঘুমে।
ককপিট থেকে ভেসে এল পাইলট এর ঘোষণা।
‘‘ ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ, আর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা অবতরণ করতে যাচ্ছি। সম্ভবত আমরা আগামী ১৫ মিনিটের মধ্যে স্পর্শ করবো জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টারমার্ক। অনুগ্রহ করে আপনারা আপনাদের সিট বেল্ট শক্ত করে বেঁধে নিন।’’
তখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন শান্তনু। একজন কেবিন ক্রু এসে আলতো করে কাঁধ ঝাকাতেই ঘুম ভাঙলো। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়ানোর পর টানা ১৪ ঘন্টার ভ্রমনে ম্যাজম্যাজে ভাব ধরেছে শরীরে। চোখ কচলে জানালার নামানো শাটার তুলে তাকাতেই একঝাঁক আলোর ঝাপটা লাগলো মুখে। নিউইয়র্কে এখন গরমকাল। ঝকমকে রোদ। পেঁজা তুলোর মতো ছড়ানো ছিটানো মেঘ। ধীরে ধীরে নানান কসরত করে ডানা ছোট করে নিচে নামছে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ বিমানটি। নিচে ছোট ছোট বাড়ি ঘর। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া কিছু সড়ক। দ্রুতগামী গাড়ি। উড়োজাহাজ যতো নিচে নামলো চিকচিক করে উঠলো আটলান্টিকের শান্ত নীল জল। ছোট ছোট ফিশিং বোট। চোখে পড়লো দু’একটা বিশাল আকারের বাণিজ্যিক জাহাজও। মিনিট দশেকের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে রানওয়েতে নেমে পড়লো উড়োজাহাজটি।
উড়োজাহাজ এর জানালার পাশে বসা শান্তনু। তার পাশের দুই সিটে রাশেদ ও মইনাক। ল্যা-িং এর সময় তিন বন্ধু শক্ত করে ধরে থাকলো অপরজনের হাত। বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। ভালোলাগায় ভরে গেছে মন। জানালা দিয়ে চোখে পড়ে দুরের টার্মিনাল ভবন। ঝাঁকে ঝাঁকে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দেশের পতাকাবাহী উড়োজাহাজ। বিমানবন্দর কর্মীদের ব্যস্ত ছুটোছুটি। কয়েকজন সতর্ক নিরাপত্তা রক্ষীর শকুন চোখ দৃষ্টি এড়ায়না শান্তনুর। সুপরিসর বিমানটি থেমে যেতেই হৈ চৈ এ মেতে উঠলো মাঝের অংশের ৫২ জন কিশোর-কিশোরী। শান্তনু তার অন্যতম। যেন অনেক দিনের বোনা স্বপ্নের ফসল আজ প্রবল ¯্রােতে ঘরে ঢুকছে।
শান্তনু ও লেভেলে পড়ে। ধানমন্ডির হোপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। তাদের দলে ৫২ জন ছেলেমেয়ে। শফিক আর জামান স্যার তাদের গাইড। মোট অভিযাত্রী ৫৪ জন। স্টাডি ট্যুরে আমেরিকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবে তারা। ২০ দিনের সফর। অবশ্য অন্য কোন স্থান তেমন টানেনি শান্তনুকে। তার স্বপ্ন নাসার স্পেস সেন্টার। যে স্বপ্নের জাল বুনে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। কী এক মোহনীয় বিকেল। স্বপ্নগুলো যেন সেজেগুজে সারিবদ্ধভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।  এখন তাদের এক এক করে ছুঁয়ে দেখবে শান্তনু।
উড়োজাহাজ থেকে নেমে ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা তল্লাশি ও লাগেজ পেতে আরও ঘন্টাখানেক লেগে গেল। বিকাল সাড়ে ৪টায় সারিবদ্ধভাবে তারা বেরিয়ে এল জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে। তখন পড়ন্ত বিকেল। তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। একঝাঁক শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল ক্ষুদে অভিযাত্রী দলটিকে। 
এয়ারপোর্টের বাইরে এসে ট্রলি ঠেলে মূল সড়কের পাশে এসে দাঁড়ালো দলটি। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী হাজারো মানুষের ভিড়। স্বজনদের ব্যস্ততা। আবেগঘন আলিঙ্গনে প্রিয়জনকে বরণ চলছে এদিক সেদিক। হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবের সারি। নিউইয়র্ক পুলিশ- এনওয়াইপিডি সদস্যদের সজাগ দৃষ্টি। ছুটে চলছে সারি সারি গাড়ি। এ যেন এক স্বপ্নের শহর। ঝকমকে পরিচ্ছন্ন, ছবির মতো চারপাশ।
আগেই বুকিং দেয়া ছিল ট্যুরিষ্ট বাস। যে মিনিবাসটিতে করে শিক্ষার্থীরা যাবে জ্যামাইকার হিলসাইডে। সেখানে একরাত থেকে পরদিন দুপুর আবার অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজে রওনা দেবে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যা-োতে। অবশ্য শান্তনু বাসে যাবেনা বলে আগেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিল স্যারদের কাছে। নিউইয়র্ক থাকেন শান্তনুর বড় খালা। বড় খালা নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। সঙ্গে দুই ছেলে মেয়ে।
শান্তনুকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি বড় খালা। হাতে কাগজে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড় খালা দেশে আসেননি দশ বছর। স্কাইপ কলে ছবি দেখেছেন। এরপরও ৫২ জন একই বয়সী ছেলে-মেয়ের ভিড়ে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। শান্তনুই ছুটে গিয়ে খালাকে জড়িয়ে ধরেছে। শান্তনুকে কাছে পেয়ে হুহু করে কেঁদে বুক ভাসালেন শর্মি খালা। শান্তনু বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। গত বছর এই সময়ে ক্যান্সারে ভুগে মারা যান শান্তনুর মা। শর্মি খালা যেতে চেয়েছিলেন। তবে দুই ছেলে মেয়ের পরীক্ষা আর এটা সেটা ঝামেলায় শেষতক যাওয়া হয়নি। এতোদিন পর তাই শান্তনুকে কাছে পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। এলোমেলো চুমু খাচ্ছিলেন। মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে রাশেদ, শান্তনু আর মইনাকের লাগেজ গাড়ির বনেটে তুলে ফেলেছে খালাতো ভাই শাওন। বন্ধু মইনাক এবং রাশেদও  যাচ্ছে শান্তনুর সঙ্গে।
জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পেছনে ফেলে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। দুধারে ছবির মতো সাজানো বাড়িঘর। বড় খালা পেছনের সিটে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন শান্তনুকে। শান্তনু অবাক চেয়ে দেখছে গাড়ির জানালায় ঝুলে থাকা নিউ ইয়র্ক। সারি সারি গাড়ি। সাপের মতো প্যাচানো উড়াল সড়ক। কার্ডবোর্ড এ ছবির মতো আঁকা বাড়িঘর। দুপাশে রঙিন গাছ। খালা বললেন, এখন ফল সিজন। শীতের আগে গাছের সব পাতা লাল বা খয়েরি হয়ে ঝুলে থাকবে। তারপর শীত আসলে সব পাতা ঝরে ন্যাড়া মাথায় বরফ মাখবে গাছগুলো। পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলেছে বিশাল বিশাল কার্গো ভ্যান। পুলিশের একটি গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে সাঁই করে ছুটে গেল পাশ দিয়ে। শব্দ শুনে নড়ে চড়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে বসা শাওন। সামনের আসনে বসা ছোট বোন সোহানীর সিট বেল্ট ঠিকঠাক আছে কি না তা পরখ করে নিল একপলকে।
বিকাল সাড়ে ৫টা। শান্তনুর বড় খালাদের বাড়ি নিউইয়র্কের কুইন্স ভিলেজ। অভিযাত্রী দলের বাকিরা থাকবে জ্যামাইকার হিল সাইডে। হিল সাইড থেকে কুইন্স ভিলেজ আধা ঘন্টার ড্রাইভ। হিল সাইড পেরিয়ে শান্ত নিরিবিলি আবাসিক এলাকা কুইন্স ভিলেজে ছবির মতো সাজানো একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে থামলো বড় খালার লেটেষ্ট মডেলের হোন্ডা সিভিক গাড়ি। বাড়ির সামনে মাচানে লাউগাছ। কটা টমেটো। দুটো বেগুন। কয়েকটা আকাশী মরিচ গাছে ঝাঁকড়া মরিচ লাল হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। দরজা খুললেন বড় খালু। কিছুক্ষণ আগে তিনি ফিরেছেন বাইরে থেকে। সালাম করলো শান্তনুরা। বুকে জড়িয়ে নিলেন খালু। আজ যেন কতোদিন পর কুইন্স ভিলেজের এই বাড়িটায় উৎসবের রঙ লেগেছে। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রামের সুযোগ দিলেন না খালু। সময় কম। সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্যবিহীন গন্তব্য । স্থান নিউইয়র্ক শহরের ডাউন টাউন ম্যানহাটান।  বিশ্বের তাবৎ উুঁচু ভবন। বড় বড় কর্পোরেট হাউস। আকাশচুম্বী দামের ব্রা-ের দোকান। হার্ডসন নদীর দু ধারে যেন স্বপ্নপুরী। অবাক দৃষ্টিতে জানালায় তাকিয়ে আছে শান্তনু, রাশেদ ও মইনাক। আলো ঝলমলে এই রাতের নিউইয়র্ক যেন স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। ম্যানহাটানের অলি গলি ঘুরে গাড়ি এসে থামলো টাইমস স্কোয়ারে। নিয়ন সাইন আর ডিজিটাল ডিসপ্লের যেন অন্যরকম স্বপ্নপূরী। হাজারো উল্লসিত মানুষ। কতো ধর্ম কতো বর্ণ। সব মিলে মিশে একাকার। হিড়িক পড়েছে দাঁড়িয়ে, বসে , দল বেঁধে ছবি তোলার। উচ্চ শব্দে ওয়েষ্টার্ণ মিউজিক এর আবহ চারপাশে। কোন এক স্বপ্নপূরীতে হারিয়ে যেতে লাগলো শান্তনু। মইনাক আর রাশেদও তলিয়ে যেতে থাকলো স্বপ্নের ভূবনে।
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলো তারা। বড় খালা গাল ফুলিয়ে বসে আছেন।
বড় খালা বললেন, ‘‘ ছেলেগুলো কতো লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এলো। আর তুমি বসারই সুযোগ দিলা না। বিশ্রাম তো দূরের কথা। আহারে... মুখ শুকিয়ে গেছে বাচ্চাগুলার।’’
বড় খালু হাসলেন। রহস্যের হাসি।
‘‘ কতো না ক্ষিধা পেয়েছে বাবা শান্তনুর। উফ শাওনের বাবা তোমাকে নিয়ে আর পারিনা। গেলেই যদি কেন আগে ফিরলানা। খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে সেই কখন। এই তোমরা যাও। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো। ’’
খালা ব্যস্ত হলেন টেবিল সাজাতে। বড় খালু মুখ টিপে হাসলেন। চোখাচোখি হতে শাওনও হেসে ফেললো। ম্যানহাটানের রাস্তায় বাঙালি কারিগরের হাতে আফগান খাবার ‘জাইরো’ খেয়েছে সবাই পেট পুরে। খালা শুনলে রাগ করবেন। তাই সবার মুখ বন্ধ।
টেবিলে খাবার সাজালেন শর্মি খালা। ধেঁাঁয়া ওঠা সাদা ভাত, ছোট মাছের চচ্চরি, বেগুন ভাজা, চ্যাপা শুটকির ভর্তা, সর্ষে ইলিশ আর ঝাল চিকেন কারি। ভরা পেট। তবুও এমন খাবারের লোভ সামলাতে পারলোনা কেউই। খাওয়া শেষে ঘুমের পালা। বড় খালা সারা রাত ঘুমাননি। শান্তনুকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। শান্তনু তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। হাত ধরে বসে রইলেন শর্মি খালা। ফজরের নামাজ পড়ে আবার কোমর বেঁধে নেমে গেলেন রান্নায়। সকাল ১১ টায় শান্তনুদের লাগার্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আবারো কেঁদে বুক ভাসালেন শর্মি খালা। দুই শিক্ষককে অনুরোধ করলেন ফেরার পথে শান্তনুদের অন্তত আরেকবার বাসায় আনার সুযোগ দেয়ার।

No comments:

Post a Comment

দিনাজপুরে লোহার খনি পেলেন বিশেষজ্ঞরা: মান অন্য যে কোন দেশের চেয়ে ভাল

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার ইসবপর গ্রামে উন্নত মানের লোহার আকরিকের (ম্যাগনেটাইট) খনির সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ...